মূল্যস্ফীতিতে আসলেই অসহায় মানুষ

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আসলেই অসহনীয়। প্রকৃতপক্ষেই অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ।

এক্ষেত্রে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং’ (সানেম)-এর জরিপ অস্বীকার করার উপায় নেই। মূল্যস্ফীতি যেভাবে বেড়েছে, বিপরীতে মানুষের আয় বাড়েনি।

বৃহস্পতিবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে অর্থনীতিবিদরা এমন মন্তব্য করেন। তবে বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সানেমের রিপোর্ট দেখা হয়নি। তবে বিশ্ববাজারের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষকে খাদ্য সহায়তাও অব্যাহত রয়েছে।

প্রসঙ্গত নিম্নআয়ের মানুষের ওপর বুধবার একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং’ (সানেম)। জরিপে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য নেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আলোচ্য ৬ মাসে ৭৪ শতাংশ পরিবার ধার করে চলছে। ১৮ শতাংশ নিম্নআয়ের পরিবারের কখনো কখনো পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৭১ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার খেয়েছে। আর ৩৭ শতাংশ পরিবার মাঝে মধ্যে কোনো এক বেলা খাবার না খেয়ে থেকেছে। ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে আগামী ৬ মাসে আরও ধার করতে হবে।

জরিপ রিপোর্টে আরও বলা হয়, উচ্চমূল্যের কারণে ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল, ৭৭ শতাংশ ডিম, ৮৮ শতাংশ মাছ এবং ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে ৯০ শতাংশ পরিবার। এছাড়া ৪৫ শতাংশ পরিবার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ধার করেছে, যার পুরোটাই উচ্চ সুদ। ৩৫ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যের কারণে ৫৫ পরিবার সঞ্চয়বিমুখ হয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, নিঃসন্দেহে মূল্যস্ফীতি উদ্বেগজনক। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। নিম্নআয়ের মানুষ অসহায়। বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আমি অনেকবার বলেছি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক নিচে নেমে এসেছে। এতে নিম্নআয়ের মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। যারা দুই বেলা খেয়ে থাকত তারা এক বেলা খাচ্ছে। অনেকেই কম খাচ্ছে। আবার কেউ কেউ আমিষের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সবকিছু মিলে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। এ অবস্থায় অবশ্যই সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। সরকার ১ কোটি মানুষকে খাদ্য বিতরণের কথা বলেছে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা রয়েছে। কীভাবে এটি বিতরণ হবে, তা বড় প্রশ্ন। কারণ আমাদের দেশে এ ধরনের কর্মসূচিতে যা সাহায্য পাওয়ার কথা, তারা পায় না। মাঝে অনেক দুর্নীতি হয়। এটি বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, সানেমের জরিপটি দেখা হয়নি। তবে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর ১৮ শতাংশ পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার খাচ্ছে, মাঝে মধ্যে একবেলা খাচ্ছে, অনেক পরিবারের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে-জরিপের উঠে আসা এসব তথ্য তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। এজন্য বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। ডলারের মূল্য বেড়ে টাকার মূল্য কমেছে। অনেক পণ্য বেশি মূল্য দিয়ে আমদানি করতে হচ্ছে। এরপরও আমরা সাশ্রয় মূল্যে এক কোটি পরিবারকে ভোজ্যতেল, চিনিসহ অন্যান্য পণ্য দিচ্ছি। সরকার বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে এসব পণ্য সরবরাহ করছে। এটি ঠিক, মানুষের কষ্ট হচ্ছে-এটা আমাদের সবাইকে স্বীকার করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, মানুষের কষ্ট হচ্ছে। এখন একটু সাশ্রয়ী হয়ে কষ্টটা পার করতে হবে। আশা করছি এর উন্নতি হবে। বিশ্বব্যাপী সবাই আক্রান্ত হয়েছে। ইংল্যান্ডে টমেটো কিনতে গেলে তিনটির বেশি কোনো পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে না। এরপরও দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ওপর চাপ পড়েছে। আমরা দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

এদিকে সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গরুর মাংস, চিনি, সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় অনেক বেশি। বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে এটি হয়েছে। যে কোনো সংকটে তার সুযোগ নিয়ে আমদানিকারকরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে হিসাব করলে ঢাকায় চারজনের পরিবারে খাদ্যের পেছনে মাসিক ব্যয় ৭ হাজার ১৩১ টাকা। আর মাছ-মাংস যুক্ত হলে ব্যয় তিনগুণ বেড়ে ২২ হাজার ৬৬৪ টাকায় দাঁড়ায়। কিন্তু একজন শ্রমিকের ন্যূনতম আয় এর চেয়ে অনেক কম।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সানেমের রিপোর্টের সত্যতা রয়েছে। আমি রিপোর্টটি দেখেছি। এটাই দেশের বাস্তবতা। তিনি বলেন, নিম্নআয়ের মানুষের বড় শত্রু মূল্যস্ফীতি। তারা কম খাচ্ছে অথবা না খেয়ে থাকছে। কিন্তু এগুলো অনেকে বলতে চাচ্ছে না। তবে কাউ না কাউকে বলতে হবে। সানেম দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে সেই কাজটাই করছে।

তিনি আরও বলেন, আজকের যে অবস্থা, এজন্য বিশ্ববাজারের পাশাপাশি সরকারের ব্যবস্থাপনায় সংকট রয়েছে। যে কারণে হঠাৎ করে মুদ্রার বিনিময় হার ৮৫ থেকে ১০৫ টাকায় উঠে গেছে। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলার কিনতে ১০৫ টাকা লাগে। এতে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, এর আগে সরকার বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করেছে। বর্তমানে সাধারণ মানুষকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে। এর সুযোগ নিয়ে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে।

খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমি সানেমের রিপোর্ট দেখিনি। আমরা খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে এমন কোনো জরিপও করিনি। তাই কত শতাংশ মানুষ কী খাচ্ছে তা আমাদের জানার কথা নয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় প্রধান খাদ্য চাল ও আটা নিয়ে কাজ করে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত চাল ও আটা মজুত আছে। যারা চাল ও আটার জন্য আসেন আমরা কাউকে খালি হাতে ফিরাচ্ছি না। সব খাবারের দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নয়।

পূর্বের খবরমুখ দেখে নয় মনোনয়ন মিলবে জনপ্রিয়তায়
পরবর্তি খবর৩০০ মিটারের কাজ পড়ে থাকায় দুর্ভোগ